Hooligan on Hill Track-পাহাড়ের পথে-৪

(Hooligan on Hill Track-পাহাড়ের পথে-৩) এরপর.. তো আবার শুরু করা যাক সেই পুরোনো দিনের অসমাপ্ত গল্প.. বারোইয়ার হাটের চা-বিরতিতে যার যার বাসায় ফোনালাপ সেরে নিলাম আমরা.. আমি খুব বেশি আলাপে গেলাম না কেবল আমার ভাইকে আপডেট জানালাম। কারন বাসায় সব বলা যাবে না। শুভ্র ভাইয়ের সাথে কথা হলো জুন ভাইয়ের তারপর আমার আর ওয়াসিফের সাথে কথা বলে নিলেন। আর এরপর আবার চলা শুরুর আগে জুন ভাই নতুন করে ব্রিফ করলেন..

saleh-md-hassan-joe-outlaw-at-ramgarh-khagrachari-tea-estate

এরপর থেকে পথের ধরন হাইওয়ে থেকে সম্পূর্ণ আলাদা আর যথেষ্ট বিপদজনক। সরু আঞ্চলিক রাস্তা আর প্রচুর সিএনজি অটোরিকশা.. যেগুলো সবেগে ভুস্ ভুস্ করে তেড়ে আসে। আর রাস্তায় প্রচুর বাঁক.. ফলে তেড়ে আসা যানবাহন দুর থেকে দেখাই মুশকিল। তাই বাঁকে বাঁকে হর্ন দিতে হয়.. আর কোন উপায়ই নেই.। আর আরো কিছুদুর পর পাহাড়ি রাস্তা শুরু হলে রাস্তায় সরু বালু আর কাঁকড়ের লাইন হয়ে থাকে যাতে চাকা পড়লেই নিয়ন্ত্রন হারানোর সমূহ সম্ভাবনা।

আর সেই সাথে আছে কিছু পুরাতন ষ্টিল ব্রিজ.. যা আর্দ্র আবহাওয়ার কারনে প্রায় সবসময়ই ভেজা ভেজা পিচ্ছিল থাকে। এই সব ব্রিজে ওঠার আগেই বাইকের গতি কমিয়ে নিতে হবে আর ব্রিজের ওপর পারত:পক্ষে ব্রেক ধরা এড়াতে হবে কেননা তাতে পিছলে যাবার সমূহ সম্ভাবনা..

আরেকটা বিষয়, চোখ-কান সমতলের চেয়ে আরো বেশি সজাগ রাখতে হবে.. আর ঢাকার রাস্তায় চলার মতো পাকনামো করা চলবেনা। কারন রাস্তার ধার বলে কিছু নেই..সোজা পাহাড়ের খাদ। তাই অবস্থা যাই হোক রাস্তা ছেড়ে না নামাই ভালো.. বরং দুর থেকে ধীর হয়ে লাইটের সিগন্যাল দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমান সাইড দিতে হবে। তো মোটামুটি সবাই বিষয়গুলি হজম করে নিলাম.. মানে আমারা যেকজন পাহাড়ে প্রথমবার বাইক নিয়ে এসেছি..

maruf-all-rashid-june-shadiqullah-saleh-md-hassan

তো এবার আবার চলা শুরু.. এক লাইন ধরে। তবে যেভাবে সিএনজি গুলো ভুস্ ভুস্ করে আসে তাতে স্থির থাকাই দুরহ.. যথারীতি কয়েকজন স্বভাবজাত পাকনামো করেই গেল.. আমরা একে একে করেরহাট, বালুটিলা, হেয়াকো বাজার পার হয়ে ক্রমে রামগড়ের আধা পাহাড়ী রাস্তায় ঢুকলাম। সে আসলেই এক অনন্য অভিজ্ঞতা.. প্রথমবারের মতো মোটরসাইকেলে পাহাড়ে.. পড়ে যতবারই যাওয়া হোকনা কেন প্রথমবারের অভিজ্ঞতা আসলেই আলাদা। তো রাস্তার যানবাহনের চাপ কমে গেছে.. কারন আমরা একে একে নিস্বর্গের মধ্যে ঢুকে পড়ছি..

আমি সবার পিছনে.. দুচোখ ভরে গেগ্রাসে গিলছি সেই নিস্বর্গের রুপ.. অনেক বছর আগে যেই রুপ আমি বাস থেকে দেখেছিলাম আর ভেবেছি কোন একদিন ঘোড়ায় চেপে ফিরে আসবো.. এদিকে সবাই মহানন্দে বাইক টেনে যাচ্ছে.. যেন মটো জিপি রেস। আর জুন ভাই একবার সামনে আর একবার পাশে পাশে তাড়িয়ে নিচ্ছে.. মাঝে মাঝে পিছে এসে আমাকে দেখে হাসে। পরে একটা সময় পর মারুফ ভাইকে আর কেউই ওভারটেক করেনি.. উনিই প্রায় পুরো পথ সবার সামনে থেকে দলের স্পিড নিয়ন্ত্রন করে গেছেন.. আর পাহাড়ের চড়াই উৎড়াই শুরু হওয়ায় সবাই রাইড আর অবাক হয়ে আশপাশ দেখাতেই মনোযোগী ছিলো..

যাহোক পাহাড়ে অনেক গরম.. হাই হিউমিডিটি.. যা সমতলের মানুষের জন্যে ক্লান্তিকর। আর বেশ ডিহাইড্রেশন হয়, পিপাসাও লাগে.. তবে পানির ঘাটতি অনেক পরে টের পাওয়া যায়। ফলত: চেহাড়া শরীর অনেকটা নিংড়ে যায়.. আমরাও সচেতনভাবে টের পেলামনা। ঠিক রামগড় এলাকায় এসে চা বাগানের ভেতরে আমরা পুরো দল থেমে গেলাম.. আমি আবাক হয়ে গেলাম যে পাহাড়ে এসে এমন চা বাগান পাবো.. এদিকে মুলত: রাস্তা খুব বেশি উঁচু নিঁচু না.. বরং পাহাড় নিরবিচ্ছিন্ন গায়ে গায়ে হবার কারনে রাস্তা মোটামুটি কাছাকাছি লেভেলে। তবে রাস্তার ধার থেকে পাশে কিছুই নেই.. সোজা খাদ। একবার পড়লে.. বাকিটা কি হবে জানি না.. 🙂

saleh-md-hassan-joe-outlaw-ramgarh-khagrachari-tea-estate

তো এবার আমরা একটু লম্বা সময়ের জন্যে থামলাম.. যার যার মতো শি-দেয়া, রিল্যাক্স করা হলো। শি করতে যেয়ে আমি টের পেলাম ডিহাইড্রেশনের মাত্রা.. বুঝলাম আরো বেশি পানি টানতে হবে। এদিকে যার যার মতো বিড়ি ধরিয়ে শুরু হয়েছে তুমুল গল্প.. আর ফাঁকে ফাঁকে এলোমেলো ছবি তোলা.. মোটামুটি আরো ভালোভাবে সবাইকে জানার সুযোগ হলো আর সহজও হওয়া গেল.. আসলেই চমৎকার ছিল সেই সময়গুলো.. আর এটাই মনে হয় গ্রুপ রাইডের আসল মজা।

তো আবার শুরু হলো টানাটানি.. সবাই মোটামুটি রিচার্জ হয়ে গেছে.. মুলতঃ এর পর থেকেই পুরো পাহাড়ি পথের আমেজ শুরু.. সবাই মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে এসেছে.. আর টানছে। আর আমি যথারীতি আমার একশনক্যাম অন করে রেখে মোটামুটি ধীরে চারপাশ গিলছি.. এদিকের পথও মোটামুটি সমান ধরনের তবে থেকে থেকে রাস্তার পাশে খাড়া ঢাল নেমে গেছে আরো অনেক নীচে.. একবার পড়লে আর দুনিয়া দেখা লাগবে না..!!

steel-bridge-matiranga-khagrachari

তবে এর পর থেকে থেকে একেকটা করে বড় ডাউনহিল আসছে আর আমরা হৈ হৈ করে উঠছি আর সেই উৎসাহে অবাক হয়ে যাচ্ছি.. আর আমার মনে পরে যাচ্ছে আনে আগে যখন বাসে করে একবার এসেছিলাম তখন ভোর বেলা ঘুম থেকে জেগে বাসের জানালা দিয়ে পাহাড়ী পথের এই রুপ দেখে আমি আক্ষরিক অর্থেই হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আর সেই সাথে রয়েছে কিছু বহু পুরাতন ভাঙ্গা নড়বড়ে আর পিচ্ছিল ষ্টিল ব্রিজ.. যার অনেক নীচ দিয়ে চিকন নদী আবার কতোগুলোর নীচে তো পাহাড়ী চিকন বাঁশের থোক। দেখে মনে হয় কোনভাবে ব্রীজ তেকে পড়লে একদদম বাশের ডগায় শুলে চড়ার মতো আটকে থাকতে হবে.. হাহ হাহ হা..

তো আগের সেই ভয়ঙ্কর স্টিল ব্রীজের অনেকগুলোই এবার আর দেখলাম না.. তার বদলে বড় বড় নতুন সিমেন্টের ব্রীজ তৈরী করা হয়েছে আর রাস্তাও মোটামুটি বড় করা হয়েছে।  তো এভাবে আমরা সবাই সেই সবুজ, নীল আর বাদামী মাটির নিসর্গের মাঝে ধেয়ে চলে একে একে জালিয়াপাড়া, গুইমারা পার হয়ে মাটিরাঙ্গা এলাকায় ঢুকলাম..

adv-mashuque-matiranga-checkpost-hill-khagrachari

মাটিরাঙ্গা বাজার পার হবার পর কয়েকটা কাটা পাহাড় পার হয়ে দেখি সবাই মেইনরোড ছেড়ে বাঁয়ে একটা ইটের হেরিং-বোন রাস্তা ধরে বেশ উঁচুতে একটা পহাড়ে উঠছে.. আমি কখনো এরকম ন্যাড়া রাস্তায় সোজা খাড়া পাহাড়ে কখনো বাইক তুলে দেইনি.. তো কি আর করা.. দিলাম এ্যডভোকেট মাশুক ভাইয়ের সাদা ফেজারের পিছে টান। ভালভাবেই শেওলা ধরা পিছলা ইটের উপর দিয়ে পাহাড়ে উঠলাম। ওহ এটা দেখি একটা আর্মি ক্যাম্প.. পাশের আর একটু বড় পাহাড়ের উপর ক্যাম্প আর এই খাটো পাহাড়ে একটা ওয়াচ শেড.. বিষয়টা সেই মজা লাগলো আমার..

সবাই বাইক থেকে নেমে পড়লাম.. আর্মি ক্যাম্প থেকে পরিচয় আর আসার কারন জানতে চাইলো.. জুন ভাই ট্যাকল করলো। আমরা ক্যাম্প এর দিক বাদ দিয়ে অন্য দিকের পাহাড় সহ ছবি তুলতে লাগলাম.. চরম লাগলো জায়গাটা.. আমি অবাক হয়ে সব গিলতে থাকলাম.. আর সেই সাথে চলতে থাকলো বিড়ি আর গল্প.. সবাই খুবই এক্সাইটেড আর খুবই উপভোগ করছে.. আসলেই বারবারই বলতে হচ্ছে সেই মুহুর্তগুলো অসাধারন ছিল.. আজো উজ্জল হয়ে আছে সেই দিন আর সময়গুলো..

hooligan-on-hill-track-saleh-md-hassan

তো সেখানে মোটামুটি অনেকটা সময় কাটিয়ে এবার নামার পালা.. জুনভাই সবাইকে সাবধান করে দিলেন। কারন শেওলা ধরা ইটের ঢালু রাস্তা.. কোন ভাবেই ব্রেক ধরে চাকা লক করা যাবেনা.. হাহ্ হাহ হা এটা একটা টেষ্ট ছিল.. তো একে একে রিমন, মারুফ ভাই, জহির ভাই নেমে গেল। তারপর মাশুক ভাই, জুন ভাই, সাঈদ ভাই সবাই নেমে গেল, আমিও নামতে থাকলাম.. আমার পেছনে রনি ভাই আর ওয়াসিফ চলে আসলো..

জুন ভাইয়ের ভয় দেখানো নসিহত শুনে ধীরে ধীরে কিছুদুর নামার পরই দেখি মাশুক ভাইয়ের বাইক ডানপাশের পাহাড়ের খাঁজের নালায় উল্টে গেছে.. রিমন, মাশুক ভাই আর জহির ভাই মিলে টেনে বের করছে। জুন ভাইও দেখি রাস্তায় বাইক রেখে দৌড়ে আসছে। কিছুদুর নেমেই চাকা পিছলানোর দাগ দেখে বুঝলাম চরম ঢালু আর পিছলা জায়গাটাতেই চাকা লক হয়ে মাশুক ভাইয়ের বাইক পিছলে নেমে গেছে।

hill-slide-matiranga-check-post

যা-হোক বাইক টেনে নালা থেকে বের করে নিয়ে আসা হলো.. রিমন বাইক এনে রাস্তায় রাখলো.. তেমন কিছু হয়নি কেবল সাদা ফেজারের ডানপাশের মিরর ভেঙ্গে গেছে আর একজষ্ট মাফলারে ঘষা লাগছে.. ভাগ্য ভালো যে বামপাশের খাড়া ফাঁকা দিকে পিছলায় নাই.. তাহলে সমস্যাই ছিল..!!

যাহোক সবাই নেমে আসার পর আরেক দফা ছবক দিলেন জুন ভাই.. আর আবার চলা শুরু করলাম আমরা.. এবার আর থামাথামি নেই.. সোজা ১৬কিমি দুরে খাগড়াছড়ি শহর। অনেক আগে মাত্র একবার এসেছিলাম এই বুনো সুন্দর শহরে.. আজ অনেকদিন পর যখন বাইক নিয়ে খাগড়াছড়ি গেট দিয়ে ঢুকলাম তখন অপার আনন্দে ভরে গেল আমার ভেতরটা.. মনে হলো আমার চোখদুটো যেন ভিজে গেছে। এবার আমি সবাইকে ডিঙ্গিয়ে শহরের ভেতর ঢুকে গেলাম.. আসলে সেই অনুভুতিটা বলে বোঝানো সম্ভব না।

khagrachari-town-panchari-bus-stop

তারপর আমরা সবাই খাগড়াছড়ির বাজার হয়ে সিস্টেম রেষ্টুরেন্ট এ চলে গেলাম। বেলা দেঢ়টা পার হয়ে গেছে.. এক একে নয়টা বাইক খুব সুশৃঙ্খলভাবে শহর হয়ে সিষ্টেমের সামনে এসে দাড়ালো। সবাই অবাক হয়ে আমাদের দেখছে.. আমরা রেস্টুরেন্ট দেখে খিদা টের পেলাম। সবাই জ্যাকেট, হেলমেট, গ্লাভস ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে বসে পড়লাম.. মং দাদা আপ্যায়নের কোন ত্রুটি রাখলো না.. আর সেই বাঁশের আর মাশরুমের তরকারির কথা আর কি বলবো.. আমার মতো ভোজন বিরাগী মানুষও সিস্টেমের কুচকুচে বাঁশ আর মাশরুমের ভক্ত.. হাহ হাহ হা.. আর সেই সাথে স্থানীয়দের অবাক দৃষ্টি আসলেই মনে রাখার মতো..

তো এই ছিলো পাহাড়ে প্রথম দিনের প্রথম বেলার গল্প.. এর পর আমাদের যাত্রা রাঙ্গামাটি শহরে। সেখানে পযটনের নতুন বিল্ডিং এ আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা আছে। এখন কথা হলো আমরা সাজেকে যাবো কিনা। দেখা গেলো বেলা বেশি নেই, আর আপ-ডাউন মিলে মোট ১৪০কিমি অদেখা পথে গিয়ে ফিরে এসে আবার রাঙ্গামাটি যাওয়া আমাদের মতো নতুন মানুষ নিয়ে রিস্ক হয়ে যায়। আর অনেকেরই জানা সেইসময়ে খাগড়াছড়ি থেকে রাঙামাটির রাস্তায় সন্ধ্যার পর চলা বেশ বিপদজনকই বটে..

system-restaurant-khagrachari-saleh-md-hassan

তাই সব বিচারে আমরা এবারের মতো সাজেক বাদ রাখলাম.. আসলে এটা আগেই মোটামুটি বাদ রাখা ছিলো.. কেবল আবার আমরা ভোটাভুটি করে নিলাম। তবে আমাদের এই সিদ্ধান্তটা আসলে কতোটা ঠিক ছিলো পরে যখন দুসপ্তাহ পর আমরা আবার সাজেকে ঘুরেছি তখন খুব ভালো ভাবে বুঝেছি। কেননা সমতলের ১৪০কিমি আর পাহাড়ের ১৪০ কিমির মধ্যে আকাশ-পতাল পার্থক্য.. আর পারিপার্শ্বিক অবস্থাতো আছেই.. আর সেই সাথে পাহাড়ে সন্ধ্যা হঠাৎ করেই নামে.. হঠাৎ করেই অন্ধকার হয়ে যায়..

(চলবে).. (Hooligan on Hill Track-পাহাড়ের পথে-৫)