(Hooligan on Hill Track-পাহাড়ের পথে-৭ এরপর..) তো একা একা থানচিতে ঢুকে পড়লাম.. কিছুই চিনি না আর চিনতেও হয়নি.. সরাসরি সাঙ্গু নদীর উপরে বিশাল এক কংক্রিট ব্রীজে এসে থামলাম। সবাই হয়তো এসেই পড়বে.. সময় কম.. তাই ফটাফট ক্যামেরা বের করে ঠাঠা রোদের নীচে কিছু ছবি তুললাম..
দুজন উৎসাহী বাঙ্গালী দিনমজুর এসে জুটলো.. ওদের ও ছবি তুললাম.. ওদের একজন আবার আবদার করে বসলো যে বাইকে বসে ছবি তুলবে.. কি আর করা নিরাপত্তার জন্যে বাইকের চাবিটা খুলে নিয়ে ওর আবদার পূরণ করলাম.. একটু গল্পও শুনলাম ওদের..
ওরা বাঁশের কাজ করে.. এখানকার স্থানীয় না.. তবে অনেক বছর ধরেই বছরের বেশিরভাগ সময়ে এখানে কাজের জন্যে আসে.. অবাক লাগলো ওরা স্থানীয় উপজাতীদের কাজই করে দেয় কন্ট্রাক্টে.. যাহোক রোদের তাপে পুড়ে যাবার অবস্থা.. আমি আবার বাইক স্টার্ট দিয়ে সোজা একটা সরকারী কোয়ার্টারের মতো একটা আবাসিক বিল্ডিংয়ের সামনে বড়ই গাছের ছায়ায় থামলাম, আর ব্যাকপ্যাক থেকে পানি টানতে থাকলাম..
দেখলাম একপাশে সরকারী কোয়ার্টার আর অন্যপাশে বুঝলাম স্কুল.. স্কুলের পোলাপান প্রবল আগ্রহে জানালা দিয়ে আমাকে চিড়িয়াখানার জন্তর মতো দেখছে.. আমিও খুব মজা পাচ্ছি.. আর এর বেশ কিছুক্ষন পরে একে একে জুন ভাই, মারুফ ভাই আর বাকিরা চলে আসলো.. হাহ হাহ হা আনেকটা রাখালের পিছে গরুর পাল.. J
তো জুন ভাই আসার পর আমাদের সাথে থাকা গাইড জানালো আমাদের বাইকগুলো এই জায়গাতেই থাকবে.. তারপর রেমাক্রিতে আমাদের পেট্রো এভিয়েশনের থাকার ব্যাবস্থা যিনি করেছেন সেই ট্যুর অপারেটর সাইফুল ভাইয়ের সাথে মোবাইলে কথা বলেও তা-ই কনফার্ম হওয়া গেল..
তো আমরা বাইকগুলো সেই বড়ই গাছের তলাতেই একসাথে রেখে ভালো করে লক করে দিলাম.. আমারটা কভার দিয়ে ভালো করে ঢেকে দিলাম.. সবাই হাসতে লাগলো.. বললো মফিজ রংপুর থেকে এখানকার জন্যেই বাইকের কভার বয়ে এনেছে.. আর কি যে আছে ওই ব্যাগের ভিতর আল্লাহই জানে.. হাহ হাহ হা..
তো আমরা সবাই ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে চললাম থানচি বাজারে। সেখানে লোকাল গাইড শচীনের দোকানে গিয়ে হেলমেট, জুতা আর অন্যান্য জিনিষপত্র যা রেমাক্রিতে লাগবে না তা রাখলাম। কারন আমাদের হয়তো অনেকটা পথ হাটতে হবে আর সেই সাথে নৌকার ওজনও বাড়ানো যাবে না..
এখানকার নৌকাগুলো আবার বিশেষভাবে তৈরী কেবল এইসব পাহাড়ী উম্মত্ত নদীতে টিকে থাকার জন্যে, আর তাতে বাড়তি ওজন চাপানোর কোন মানেই হয় না। তো এরপর বাজার থেকে পানি থেকে ব্যাগ রক্ষার জন্যে বড় পলিব্যাগ ও কিনলাম আমরা.. তখন কিছু পরিস্কার না বুঝলেও বুঝলাম নদী পথটা আর দশটা নদী পথের মতো নয়.. পাহাড়ী নদী.. বেশ বিপদসঙ্কুল.. যা হোক কোন ধারনা না থাকলেও আগে জানার কারনে মোটমুটি সবারই প্রস্তুতি নেয়া আছে।
তো এই ফাকে থানচি বাজার থেকে আমরা হালকা সিঙ্গারা, বিস্কুট যা পেলাম খেয়ে নিলাম.. ভাত খাবার সময় নেই.. এর মধ্যে থান্চি বিজিবি ক্যাম্পে নাম এন্ট্রি করাসহ বাকি কাজ সারতে হলো.. সাইফুল ভাইয়ের সাথে পরিচয়ও হলো.. আমাদের লোকাল গাইড সাথে যাবে না বলে একটু ঝামেলাও পোহাতে হলো।
আমি বেলা পৌনে বারোটায় থানচিতে ঢুকেছি আর বাকিরা ঢুকেছে আরো আধা ঘন্টা পরে.. আর এদিকে আমাদের সব কাজ সেরে নৌকায় উঠতে বেলা দেঢ়টা পার হয়ে গেল.. তো সেই নৌকা আবার এতো চিকন আর তলা মোটামুটি গোল ধরনের যে নড়ানড়ি করা দুরহ.. আর এক নৌকাতে দুই মাঝিসহ নৌকার পাটাতনের প্রতিভাগে লম্বায় একজন একজন করে আর মাত্র চার-পাঁচ জন বসার আয়োজন..
আমদের গাইড সাইফূল ভাই সহ আমরা পুরো দশজন হয়ে গেছি তাই একেকটা নৌকাতে আমরা পাঁচ জন করে বসলাম.. ঠিক মাঝখানে ব্যালেন্স করে বসার পর বুঝলাম এটা পাহাড়ী স্রোতের বিপরীতে টিকে থাকার জন্যেই এমন করে বানানো.. তবে সেই স্রোত কেমন তার নমুনা দেখলাম মোটামুটি আধা ঘন্টা নৌকা চলার পর।
তবে এর মাঝে নৌকায় চড়ার পর আমাদের হুল্লোড় আর কে দেখে.. আমরা নিজেরাই যেন একেকটা রাজহাঁসের মতো পাখা মেলে দিয়েছি সাঙ্গু নদীর উপর। আর চার পাশের আবারিত সবুজ.. পাহাড়ের সাথে সাথে পাহাড়ীদের হাতে তৈরী বাদামী লাল মাটির ক্ষেত.. চমৎকার চাষ করে রেখেছে.. খুবই পরিশ্রম করে ওরা.. আর চাওয়ার পরিমানও খুবই সীমিত ওদের..
তবে ওদের মধ্যেও আধুনিকায়ন চেখে পড়বে আর তা অবশ্যই ওদের মতো করে.. আর আমার এই বিষয়টাই খুবই ভালো লাগে.. তবে খারাপ লাগে ওদের আর আমাদের মাঝে তুলে দেয়া বেশ দৃশ্যমান ভারী দেয়ালটা..
এই বিষয়ে পরে আমি অনেক জানার চেষ্টা করেছি, পড়াশোনা করেছি, আর কিছুটা জানতেও পেরেছি.. তাতে একের পর এক বিষ্ময় আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে.. সেসব কথা আসলে না বলাই ভালো কারন এতে জড়িত রাজনীতি, ক্ষমতা, উগ্র জাত্যাভিমান, সুবিধাবাদী চক্রের আগগ্রাসন আর সর্বোপরি শিক্ষার অনসগ্ররতা.. যা আসলে অনেক, ব্যপক আর ভীষনভাবে লুকায়িত..
যাহোক আমার ছোট্ট অভিজ্ঞতায় আমি যতটুকু দেখেছি, জেনেছি তাতে আমার কাছে মনে হয় যেকোন জাতীর একেবারে সাধারন জনগোষ্ঠিটাই অসাধারন। যেকোন স্থানেই সাধারন জনগোষ্ঠির কোন তুলনাই হয় না.. এই শ্রেনীর বেশিরভাগ মানুষই আসলে সত্যিকারের মাটির মানুষ.. আর আমার এদেরই ভালো লাগে.. আমি চেষ্টা করি এদের কাছে যেতে। ওদের মতো তো হতে পারবো না তবু একটু কাছে যেতে আর জানতে পারলে ভাল লাগে.. যা হোক অনেক ফিলোসফি কপচানো হলো, এবার আবার আমার সেই সাঙ্গু নদীতে ফিরে যাই..
(চলবে).. (Hooligan on Hill Track-পাহাড়ের পথে-৯)